ব্রেকিং:
রাণীনগরে বিদ্যুতায়িত হয়ে ভ্যানচালকের মৃত্যু রাণীনগরে প্রশিকার গাছ বিতরণ পত্নীতলায় শিক্ষার্থীদের নামে চাঁদাবাজি, যুবক আটক নওগাঁয় সপ্তাহের ব্যবধানে ধানের দাম কমেছে মনে ১০০ টাকা নিয়ামতপুরে খাল খননে ভাগ্য বদলে দিয়েছে কৃষকের রাণীনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় নারীর মৃত্যু

বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নওগাঁ দর্পন
সর্বশেষ:
রাণীনগরে বিদ্যুতায়িত হয়ে ভ্যানচালকের মৃত্যু রাণীনগরে প্রশিকার গাছ বিতরণ পত্নীতলায় শিক্ষার্থীদের নামে চাঁদাবাজি, যুবক আটক নওগাঁয় সপ্তাহের ব্যবধানে ধানের দাম কমেছে মনে ১০০ টাকা নিয়ামতপুরে খাল খননে ভাগ্য বদলে দিয়েছে কৃষকের রাণীনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় নারীর মৃত্যু
৪৪৪৫

দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২৪  

গত কয়েক বছর রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে লিখিত ‘সুবোধ’ চরিত্রটি বেশ আলোড়ন তুলেছে। দেয়ালচিত্রগুলোতে বা গ্রাফিতিতে দেখা যায়, খাঁচাবন্দি সূর্য হাতে নিয়ে পালাচ্ছে পরিচর্যাহীন চুল-দাড়ির এক তরুণ। তার ঠিক পাশে লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না।’ সুবোধ পালিয়ে যায়নি। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফিরে এসেছিল সুবোধ। জীর্ণশীর্ণ দেহে অধিকার আদায়ের মিছিলে শামিল হয়েছিল। অদম্য সাহসিকতায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল বুলেটের সামনে। সুবোধ তার এবং তাদের বিজয় নিশ্চিত করেছে। গ্রাফিতির বাস্তব রূপায়ণে এটা মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আন্দোলনকালে, যা প্রায় এক মাস ধরে চলেছে, রাজধানীর দেয়ালগুলোতে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ, ঘৃণা আর দ্রোহের ভাষা ফুটে ওঠে। তবে সরকার পতনের পর বদলে যায় দেয়ালের লিখনভাষা, ভাষাচিত্র। দেয়ালে নতুন করে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ আর নতুন দেশের স্বপ্ন।

গত রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, টিএসসি, ফুলার রোডসহ বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্র। টিএসসির পশ্চিম পাশের দেয়াল জুড়ে লেখা হয়েছে, ‘এখন দরকার জনগণের সরকার’। তার পাশেই লেখা, ‘জেনো ওহে! আমাদের রক্তে চারটি কণা। শে^ত, লোহিত,অনুচক্রিকা সঙ্গে বারুদদানা।’

একটু এগিয়ে দেখা গেছে, আজিমপুরের একটি স্কুলের তিন শিক্ষার্থী দেয়াললিখনে ব্যস্ত। কাঁপা কাঁপা হাতে একজন লিখছে, ‘স্বাধীন হতেও জানি, স্বাধীনতা রক্ষা করতেও জানি’। পাশেই আরেকজন লিখছে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের কথা।

আনিকা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখন স্কুলগুলোতে যে কারিকুলাম রয়েছে তাতে একজন শিক্ষার্থীকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। সবার সে সামর্থ্য নেই। নতুন কারিকুলামে নির্দেশনা রয়েছে, যে কাজগুলো করানো হবে, সব স্কুল কর্তৃপক্ষ করানোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তারা তো ব্যবস্থা করছে না। বইয়ের নির্দেশনার চেয়েও কঠিন কিছু দিয়ে দিচ্ছে। আমরা মনে করি, কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলে ভালো হয়।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্সরা বলেন, ‘স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু রক্ষা করা তো কঠিন। আমরা দেয়ালগুলোতে স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানাব।’

নওশীন নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা জেনারেশন জি। আমাদের পরের জেনারেশন হবে ‘আলফা’। আমরা তাদের জন্য সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। আজকের দিনটির জন্য আমাদের অসংখ্য ভাইবোনকে রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা চাই না পরবর্তী প্রজন্ম এমন পরিস্থিতিতে পরুক।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা। টিএসসিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর সারা দেশে তুমুল প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হাতের কাছে যা কিছু ছিল তাই নিয়ে রাস্তাায় নামেন নারী শিক্ষার্থীরা। কেউ রুটি বেলার বেলুন, কেউবা সবজি কাটার বঁটি, কেউ আবার ঝাড়– নিয়ে নেমেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেসব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, শহীদ মিনারের আশপাশের দেয়ালগুলোতে। তাতে লেখা রয়েছে বাংলার মায়েরা-মেয়েরা সবাই এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা। তার পাশে দুজন নারীর চিত্র এঁকে ওপরে লেখা হয়েছে বর্ণবিবাদ অগ্রহণযোগ্য।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার, সাংবাদিক হত্যার বিচার আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে শিববাড়ী আবাসিক এলাকার দেয়ালগুলোতে। লেখা হয়েছে, সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই, চা শ্রমিকদের বেতন বাড়াও, স্বাধীন হয়েছি এবার সভ্য হই।

দেয়ালচিত্র আঁকছিলেন ইলা নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে গুম, খুন বেড়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য বেড়েছে। দেশের জনগণের বড় একটি অংশ পিছিয়ে রয়েছে। এসব দেয়ালচিত্রের উদ্দেশ্য, সেসব কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বা ভবিষ্যতে করবেন, তারা যেন এগুলো মাথায় রাখেন।’

বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, দুর্নীতিবিরোধী সেøাগান ঠাঁই পাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের দেয়ালগুলোতেও। গত রবিবার দেয়ালচিত্রের কাজ করতে দেখা গেছে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। নিজেরাই অর্থ সংগ্রহ করে এসব কাজ করছে তারা।

আফ্রিদা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘উদয়ন থেকে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই, তা দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমাদের বাংলাদেশে অবশ্যই বিদ্যাবিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা চাই একটা বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।’

একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সিয়াম বলেন, ‘প্রশাসনের অনেক নিষ্ঠুরতা দেখেছি। আমাদের ভাইদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। আমরা দেয়ালগুলোতে সেসব চিত্র এঁকেছি। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে দাবি আদায়ের জন্য আর কাউকে যেন প্রাণ দিতে না হয়।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম হটস্পট ছিল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়। আশপাশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এখানে সক্রিয় ছিল। আন্দোলনে কয়েকজন শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। তাদের স্মরণে আন্দোলনের সময়ের চিত্রগুলো দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছে শিক্ষার্থীরা।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, সিটি কলেজের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী দেয়াললিখনের কাজ করছে। রংতুলির আঁচড়ে দেয়ালগুলোতে তুলে ধরেছে জুলাইয়ের দিনগুলোর চিত্র। এঁকেছে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার চিত্র। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিনথিয়া বলেন, ‘আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে তাদের একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। কেউ যদি দেয়ালচিত্রটি দেখে তাহলে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়বে।’

সিনথিয়া বলেন, ‘আমরা অতীতের শাসনব্যবস্থা চাই না। এমন দেশ হোক যেখানে সবাই মতপ্রকাশ করতে পারবে।’

আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী। তার স্মরণে গ্রিন রোডে আঁকা হয়েছে নানা ধরনের দেয়ালচিত্র। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নাইম বলেন, ‘আন্দোলনে আমাদের এক বন্ধু শহীদ হয়েছে, অনেক বন্ধু আহত হয়েছে। এসব ঘটনার বিচার চাই আমরা। আমাদের কলেজের দেয়ালগুলোতে সে দাবিগুলোই তুলে ধরছি।’

পাল্টে গেছে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা। আশপাশের দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন চিত্রের পাশাপাশি ধর্ষণের বিরুদ্ধেও সেøাগান লেখা হয়েছে। হাসিব ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তেজগাঁও কলেজে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করেছে ছাত্রলীগ। বেশ কয়েক বছর আগে শিক্ষার্থী ধর্ষণেরও অভিযোগ উঠেছিল। ক্ষমতার দাপটে পার পেয়ে গেছিল। আমরা সেসবের বিচার চাই।’ ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের অন্যায় না করতে পারে সে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে দেয়ালচিত্রে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক হটস্পট ছিল উত্তরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে আশপাশের চার-পাঁচটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলশিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে অংশ নেয়। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয়রা। ১৬ তারিখ থেকে চলমান এ আন্দোলনে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এখানে। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, ধীরে ধীরে মুছতে শুরু করেছে আন্দোলনে তৈরি হওয়া ক্ষোভ আর ঘৃণার চিত্র। এখন স্থান করে নিয়েছে শিকল ছেঁড়ার গল্প।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালগুলোতে আঁকা হয়ে নতুন নতুন চিত্র। কোথাও আঁকা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আবু সাঈদ। কোথাও আঁকা হয়েছে পানির বোতল হাতে ডাকছে মুগ্ধ,  পানি লাগবে পানি। এসব দেয়ালে এখন স্থান পেয়েছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। লেখা হয়েছে, যে হাতে কলম তুলেছি, সে হাতে অস্ত্র তুলব না। বিকল্প কে? তুমি, আমি, আমরা। আরেক দেয়ালে লেখা হয়েছে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া সালমান রাহাত বলেন, ‘আন্দোলনে আমি গুলিতে আহত হয়েছি। আমাদের এক সহযোদ্ধা রিজভী শহীদ হয়েছে। দুজনে পাশাপাশি ছিলাম। সেদিন বেঁচে ফিরব সেটা আশা করিনি। আমরা সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই। আমরা এমন এক দেশ চাই, যেখানে কেউ ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষ হত্যা করবে না, চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হবে না।’

নওগাঁ দর্পন
এই বিভাগের আরো খবর